"ধর্ম সাগর "কিন্তু সাগর নয়!

 

ধর্ম সাগরের দৃশ্য

নামটা শুনেই প্রথমে মনে হতে পারে এটা আবার কোন সাগর। লোহিত সাগর পড়লাম,আরব সাগর পড়লাম, কোথাও তো ধর্ম সাগর শুনি নাই। ঠিক ধরতে পেরেছেন। এটা শুধু নামেই সাগর,আয়তনে না। ছোট বেলায় আমরা অনেক শ্লোক বা ধাঁধা নিয়ে আসর জমাতাম। যেমন বলতাম কোন গ্রাম গ্রাম নয়- টেলিগ্রাম, কোন শালা, শালা নয় -পাঠশালা। 

ঠিক এমনই এক ধাঁধা বা শ্লোকের ন্যায় তুলে ধরবো কোন সাগর সাগর নয়- ধর্ম সাগর। 


ধর্ম সাগর কি? 

ধর্ম সাগর একটি বিশাল আকারের দিঘি বা পুকুর। যা কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। 


ধর্ম সাগরের ইতিহাস 

পাল আমলের  শাসক ধর্মপালের নামানুসারে এই দিঘির নামকরন করা হয়। এটি  পঞ্চদশ শতাব্দী (১৪৫৮ সালে) খনন করেন ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা ধর্মমাণিক্য। তখন বাংলায় দুর্ভিক্ষ চলছিল। রাজা ধর্মমাণিক্য তখন প্রজাদের দুঃখ বুঝে দিঘি  তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল। কেননা সেই সময় দুর্ভিক্ষের কারণে পর্যাপ্ত পরিমান জল পাওয়া যাচ্ছিল না। জলের কষ্ট নিবারণের জন্য রাজা ধর্মমাণিক্য কুমিল্লায় এই দীঘিটি খনন করে। এই অঞ্চলের জল এর দুর্ভিক্ষ নিবারন করায় ছিল রাজার ধর্ম মানিক্যের মূল উদ্দেশ্য। রাজমালা ধর্মগ্রন্থানুসারে ধর্মমানিক্য ৩২ বছর শাসন করেন। তার এই কীর্তি আজ  সাগর না হয়েও সবার কাছে ধর্ম সাগর নামেই পরিচিত। 




লিপিতে ধর্মসাগর 

তাম্রলিপি অনুসারে কয়েকটি লাইন বর্ণিত হয়েছে যা রাজা ধর্মমাণিক্যকে নিয়ে লেখা, 

"চন্দ্র বংশেতে মহামাণিক্য নৃপবর, তানপুত্র শ্রী ধর্মমাণিক্য শশধর।

তেরশ আশিশতকে সোমবার দিনে, শুক্লপক্ষ এয়োদশী মেষ সংক্রমনে।।

তাম্রপত্রে লিখি দিলাম এসব বচন, আমা বংশ মারি যে বা হয় রাজন।তাহার দাসের দাস হইবেক আমি, আমা কীর্তি ব্রক্ষাবৃত্তি না লঙ্ঘিত তুমি"

অর্থঃ

“চন্দ্র বংশোদ্ভব মহা মাণিক্যের সুধীপুত্র শশধর সদৃশ শ্রী শ্রী ধর্ম মাণিক্য ১৩৮০ মেষ সংক্রমনে (চৈত্র মাসের শেষ তারিখে) সোমবার শুক্ল এয়োদশী তিথিতে কৌতুকাদি তাষ্ট বিপ্রকে শষ্য-সমন্বিত ফল ও বৃক্ষাদি পূর্ণ উনত্রিশ দ্রোণ ভূমি দান করিলেন। আমার বংশ বিলুপ্ত হইলে যদি এই রাজ্য অন্যকোন ভূপতির হস্তগত হয়। তিনি এই বৃহ্মবৃত্তি লোপ না করিলে আমি তাহার দাসানুদাস হইব।”

উপরোক্ত লাইনগুলো পড়লেই আমরা রাজা ধর্মমানিক্যে সম্পর্কে জানতে পারি। 

শচীনদেব বর্মণকে আমরা সবাই জানি,তিনি ছিলেন একজন সুরসাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় শচীনদেবের সাথে দেখা করতে যে যে জায়গায় গিয়েছে ধর্মসাগর তার মধ্যে অন্যতম একটা জায়গা তাদের সাক্ষাৎ করার। 


ধর্মসাগরের বর্তমান অবস্থা 

প্রাচীনতম জেলাগুলোর মধ্যে কুমিল্লা অন্যতম। এ জেলাকে নিয়ে অনেক ইতিহাস রয়েছে,রয়েছে কাব্য,কাহিনি। কুমিল্লা জেলায় যতগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে তারমধ্য ধর্মসাগর অন্যতম। আমরা কুমিল্লা জেলার নাম শুনলেই প্রথমে যে কথাগুলো মাথায় আসে সেগুলো হলোঃ কুমিল্লার ময়নামতি,রসমালাই ইত্যাদি। কিন্তু ধর্মসাগর সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারন নেই। যদিও এটিও একটি প্রাচীন কীর্তি। ১৪৫৮ সালে নির্মাণ করা হলেও তারপর কোনো কাজ করা হয় নি। তবে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের উদ্দোগে দিঘিটির সংস্কার করা হয়। এখন দিঘির পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। রয়েছে সারিবদ্ধ গাছ। যা ভ্রমণ বা অতিথিদের মুগ্ধ করে। সন্ধ্যা নামলেই যেন শুরু হয় এক মিলন মেলা। বর্তমানে এর আয়তন রয়েছে ২৩.১৮ একর। এর পাশেই রয়েছে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়,কুমিল্লা স্টেডিয়াম, কুমিল্লা জিলা স্কুল, রয়েছে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যান। এটাকে ঘিরে রয়েছে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা। মানুষের ক্লান্ত মিটাতে চলে আসে এখানে, অবসর সময়ে কেউ বা হেটে বেড়ায় পাড় ঘেসে।হবেই বা না কেন একটি মনোরোম দৃশ্যের দেখা মিলে এই জায়গায়। শুধু তাই নয় শীতকালে এখানে ভিড় করে অতিথি পাখি।


শেষ কথাঃ

সাগর নাম দিয়ে বাংলাদেশে যতগুলো দিঘি রয়েছে ধর্ম সাগর তারমধ্য অন্যতম। এটি একাধারে ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্যের প্রতীক। এটাকে রক্ষা করা বা এর প্রতি সদয় হওয়া আমাদের দায়িত্ব। আমরা যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসি তাহলে প্রকৃতি তার সর্বোচ্চটা আমাদেরকে দিবেন। তাই ধর্ম সাগরের ন্যায় বাংলাদেশে ইতিহাস সমৃদ্ধ জায়গা বা বস্তু রয়েছে সেগুলোর প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এতে করে আমরা সেই ঐতিহ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো। সেই সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো। এটাই হচ্ছে বাঙ্গালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি।


মন্তব্যসমূহ